Tuesday, May 27, 2025

রাজবন বিহার: বাংলাদেশের বৌদ্ধ সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল নিদর্শন

 




ভূমিকা

রাজবন বিহার বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিহারগুলোর একটি। রাঙামাটি জেলার কেন্দ্রস্থলে, কাপ্তাই হ্রদের কাকচক্ষু জল এবং সবুজ বনানীর মাঝে অবস্থিত এই বিহারটি শুধু ধর্মীয় তীর্থস্থানই নয়, বরং একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রও। এর শান্ত পরিবেশ, মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং বৌদ্ধ ধর্মের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করে।

ইতিহাস

রাজবন বিহারের প্রতিষ্ঠা ঘটে ১৯৭৪ সালের দিকে, যখন শ্রদ্ধেয় সাধনানন্দ মহাস্থবির, যিনি বনভান্তে নামে বেশি পরিচিত, লংগদু উপজেলার তিনটিলা থেকে রাঙামাটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আমন্ত্রিত হন। চাকমা রাজপরিবারের সম্মতি এবং স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগে, যেমন কুমার কোকনাদাক্ষ রায়, সমর বিকাশ চাকমা, স্নেহ চাকমা, অরুণ চাকমা এবং অন্যান্যরা, বনভান্তেকে রাঙামাটিতে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাজমাতা আরতি রায় এই বিহার নির্মাণের জন্য রাজবাড়ীর পশ্চিম দিকে প্রায় ২৬ একর পাহাড়ি ভূমি দান করেন। ১৯৭৭ সালে বনভান্তে রাঙামাটিতে এসে এই বিহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, এবং তাঁর শিষ্যদের জন্য এই বিহারটি নির্মিত হয়।

বর্তমানে, চাকমা রাজা দেবাশিষ রায়ের তত্ত্বাবধানে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি বিহারের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। বিহারটি আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে, এবং এখানে বিশ্বের বিভিন্ন বৌদ্ধ রাষ্ট্র থেকে ভিক্ষুরা বনভান্তের শিক্ষা ও দর্শন শুনতে আসেন।

স্থাপত্যশৈলী

রাজবন বিহারের স্থাপত্যশৈলী ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ স্থাপত্যের সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি চমৎকার সমন্বয়। বিহারটি প্রায় ২২-২৬ একর জায়গার উপর স্থাপিত, যার মূল কাঠামো সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। বিহারে তিনটি প্রবেশদ্বার রয়েছে: উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে। উত্তর দিকের প্রবেশদ্বারটি আধুনিক যানবাহনের জন্য উপযোগী এবং দৃষ্টিনন্দন। দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বারে দুটি ফটক রয়েছে, যার শীর্ষে সুচাগ্র চূড়াবিশিষ্ট স্থাপত্যশৈলী বৌদ্ধ স্থাপত্যের প্রতীক। উত্তর প্রান্তের প্রবেশপথে বুদ্ধধর্মের আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রতীকী স্তম্ভ রয়েছে, যা এর শৈল্পিক মহিমা প্রকাশ করে।

বিহারের ভেতরে রয়েছে স্বর্গীয় সিঁড়ি, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যানের জন্য বিশাল গর্ত, এবং আর্যশ্রাবক বনভান্তের মূর্তি ও সংরক্ষিত শবদেহ, যা ভক্ত ও পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া, বিশ্বশান্তি প্যাগোডা নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে, যা বিহারের গৌরব আরও বাড়িয়ে তুলবে।

ধর্মীয় তাৎপর্য

রাজবন বিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পবিত্র তীর্থস্থান। প্রতি বছর এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব যেমন মহাসঙ্ঘদান, কঠিন চীবর দান, বুদ্ধ পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা এবং বনভান্তের জন্মদিন অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালিত হয়। এই উৎসবগুলোতে দেশি-বিদেশি তীর্থযাত্রী ও পর্যটকরা অংশগ্রহণ করেন, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমতলের বাঙালি বৌদ্ধদের এবং বিশ্বের বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় করে।

বনভান্তের সহজ-সরল এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ বৌদ্ধ দর্শনের ব্যাখ্যা এই বিহারকে জ্ঞানচর্চার একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। তিনি সত্য, নীতি এবং নির্বাণের পথে মানুষকে উৎসাহিত করতেন এবং মদ, জুয়া বা আত্মহত্যার মতো অশুভ প্রবৃত্তি থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিতেন।

পর্যটন আকর্ষণ

রাজবন বিহার শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, এটি প্রকৃতিপ্রেমী ও জ্ঞানসন্ধানী পর্যটকদের জন্যও একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য। বিহারটি রাঙামাটি শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং সড়কপথে (টিটিসি রোড বা জিমনেসিয়ামের পাশের রাস্তা) অথবা নৌপথে (রিজার্ভ বাজার লঞ্চ ঘাট থেকে) মাত্র ৫ মিনিটে পৌঁছানো যায়। পর্যটকদের জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, যেমন বিহার চত্বরে টুপি, বোরকা, ঘোমটা বা জুতা-স্যান্ডেল পরে প্রবেশ নিষেধ এবং ছবি বা ভিডিও ধারণের জন্য অনুমতি নিতে হয়।

এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কাপ্তাই হ্রদের শান্ত জলরাশি এবং সবুজ পাহাড়ের সমন্বয় পর্যটকদের মনে প্রশান্তি এনে দেয়। বিহারের অতিথিশালা এবং স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলোতে ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি ও বাঙালি খাবারের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

যাতায়াত

ঢাকা থেকে রাঙামাটি: ঢাকার ফকিরাপুল বা সায়েদাবাদ থেকে রাঙামাটিগামী বাস পাওয়া যায়। নন-এসি বাসের ভাড়া ৮৫০-৯০০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১২০০-১৮০০ টাকা। শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, এস আলম এবং সেন্টমার্টিন হুন্দাই রবি এক্সপ্রেসের মতো পরিবহন সংস্থাগুলো এই রুটে চলাচল করে।
চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি: চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় বা বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে গেটলক/ডাইরেক্ট বাসে ১২০-১৮০ টাকায় রাঙামাটি যাওয়া যায়।
রাঙামাটি থেকে রাজবন বিহার: শহর থেকে অটোরিকশা, প্রাইভেট গাড়ি বা নৌপথে বিভিন্ন ধরনের বোটে বিহারে পৌঁছানো যায়।

থাকার ব্যবস্থা

রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজার, দোয়েল চত্বর এবং বনরূপা এলাকায় বিভিন্ন মানের হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। পর্যটকদের জন্য লেকের কাছাকাছি থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

পরামর্শ

  • বিহারের পবিত্রতা রক্ষায় অশোভন আচরণ এড়িয়ে চলুন।

  • দলবদ্ধ ভ্রমণে খরচ কম হয় এবং ছুটির দিন এড়িয়ে গেলে ভিড় কম থাকে।

  • পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন।

উপসংহার

রাজবন বিহার শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং জ্ঞানচর্চার একটি মিলনস্থল। এর শান্ত পরিবেশ, ঐতিহাসিক তাৎপর্য এবং স্থাপত্যশৈলী এটিকে বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থানে পরিণত করেছে। রাঙামাটি ভ্রমণে এই বিহার অবশ্যই আপনার তালিকায় রাখার মতো একটি গন্তব্য।

No comments:

Post a Comment

রূপের রানী রাঙ্গামাটি: পাহাড় আর প্রকৃতির এক অপরূপ মেলা

 রাঙ্গামাটি, যাকে সবাই ডাকে “রূপের রানী”, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জাদুকরী স্থান। পাহাড়ের কোলে ঘেরা কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝরনার গান, ...